নতুন ড্রাইভারদের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করার সহজ বাংলা গাইড। অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, ট্রেনিং, টেস্ট এবং ফাইনাল লাইসেন্স—সবকিছু একসাথে।
পরিচিতি
বাংলাদেশে গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। এটি শুধু আইনগত অনুমতি নয়, বরং আপনার দক্ষতা ও সচেতনতার স্বীকৃতিও।
লাইসেন্স থাকলে আপনি ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি থেকে যেমন বাঁচেন, তেমনি দুর্ঘটনা বা জরিমানা সম্পর্কেও আত্মবিশ্বাসী থাকতে পারেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু হয়েছে, যা আগের ম্যানুয়াল সিস্টেমের চেয়ে অনেক আধুনিক ও নিরাপদ।
এই স্মার্ট লাইসেন্সে রয়েছে QR কোড, ইলেকট্রনিক ডেটা, যা সহজে যাচাইযোগ্য।
অনলাইনের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ। বিআরটিএ’র ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করে আপনি ঘরে বসেই আবেদন, ফি পরিশোধ এবং স্ট্যাটাস ট্র্যাক করতে পারেন।
এতে সময় যেমন সাশ্রয় হয়, তেমনি প্রক্রিয়াটিও হয় স্বচ্ছ ও দ্রুত।
ড্রাইভিং লাইসেন্স করার পূর্বশর্তসমূহ (Eligibility)
বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়।
কারা ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন?
ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হলে আপনার বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা অবশ্যই নির্দিষ্ট মানদণ্ডে থাকতে হবে।
আবেদনকারীর অবশ্যই বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে, এবং তার জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ থাকতে হবে।
✅ বয়সসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা:
- মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার (Light Vehicles): কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স থাকতে হবে।
- হেভি ভেহিকেল বা পেশাদার লাইসেন্স (Professional): বয়স হতে হবে ২১ বছর বা তার বেশি।
- ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা: সাধারণত অষ্টম শ্রেণি পাশ।
✅ বিভিন্ন লাইসেন্স ক্যাটাগরির জন্য শর্ত:
লাইসেন্স ক্যাটাগরি | বয়সসীমা | শিক্ষাগত যোগ্যতা | অতিরিক্ত শর্ত |
---|---|---|---|
মোটরসাইকেল (Am, A) | ১৮+ বছর | অষ্টম শ্রেণি | লার্নার লাইসেন্স আবশ্যক |
প্রাইভেট কার (B) | ১৮+ বছর | অষ্টম শ্রেণি | মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা |
পেশাদার লাইসেন্স (C, D, E) | ২১+ বছর | অষ্টম শ্রেণি বা সমমান | মেডিকেল সার্টিফিকেট, ট্রেনিং আবশ্যক |
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ডকুমেন্টস
ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়।
এই কাগজপত্রগুলো সঠিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে আপনার আবেদন বাতিল হতে পারে অথবা বিলম্বিত হতে পারে।
আবেদনকারীকে অবশ্যই নিজের পরিচয়, ঠিকানা এবং শারীরিক যোগ্যতার সঠিক প্রমাণ দিতে হবে।
আবেদন করার সময় যা লাগবে
লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার সময় আপনাকে নিচের ডকুমেন্টসগুলো প্রস্তুত রাখতে হবে:
✅ ১. জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদ
- বয়স যাচাইয়ের জন্য এই ডকুমেন্ট বাধ্যতামূলক।
- অনলাইনে আবেদন যাচাইয়ের সময় এটি প্রয়োজন হবে।
✅ ২. সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজ ছবি
- সাধারণত সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে তোলা ছবি লাগবে।
- অনলাইন আবেদন ফর্মে ছবি আপলোড করতে হয়।
✅ ৩. রক্তের গ্রুপের প্রমাণপত্র
- আপনার রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ করে এমন কোনো সরকারি বা বেসরকারি ল্যাব রিপোর্ট।
- কিছু বিআরটিএ অফিসে রক্ত পরীক্ষার সুযোগও থাকে।
✅ ৪. ঠিকানা প্রমাণ (যদি জাতীয় পরিচয়পত্রে না থাকে)
- ইউটিলিটি বিল, নাগরিক সনদ, অথবা ব্যাংক স্টেটমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
✅ ৫. মেডিকেল সার্টিফিকেট (বিশেষ ক্ষেত্রে)
- পেশাদার লাইসেন্সের জন্য এটি বাধ্যতামূলক।
- চোখের দৃষ্টি, শারীরিক সক্ষমতা ইত্যাদি যাচাই করা হয়।
অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার ধাপ (Step by Step Process)
বর্তমানে বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে।
বিআরটিএ’র অফিসে বারবার না গিয়ে ঘরে বসেই অনলাইনে আবেদন করা যায়।
নিচে ধাপে ধাপে জানানো হলো কীভাবে আপনি অনলাইনে আবেদন করবেন:
বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করা
প্রথম ধাপে আপনাকে বিআরটিএ’র অফিশিয়াল পোর্টাল ভিজিট করতে হবে:
- 🔗 https://brta.gov.bd
- 🔗 https://edl.bsp.gov.bd (ইলেকট্রনিক ড্রাইভিং লাইসেন্স পোর্টাল)
ওয়েবসাইটে গিয়ে “New Driving License Application” অপশনে ক্লিক করে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
এরপর একটি প্রোফাইল খুলে, মোবাইল নম্বর ও ইমেইল ভেরিফাই করতে হবে।
আবেদন ফর্ম পূরণ ও জমা দেয়া
রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে, আপনাকে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে। এখানে যা করতে হবে:
- আপনার ব্যক্তিগত তথ্য (নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ) দিন
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ছবি আপলোড করুন
- নির্ধারিত লাইসেন্স ফি অনলাইনে পরিশোধ করুন (Bkash/Nagad/SureCash/Bank)
সব তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করে “Submit” বাটনে ক্লিক করুন।
নির্ধারিত পরীক্ষার জন্য তারিখ নির্ধারণ
আবেদন সাবমিট করার পর, বিআরটিএ আপনার আবেদন যাচাই করে মৌখিক ও ব্যবহারিক ড্রাইভিং টেস্ট এর তারিখ নির্ধারণ করবে।
আপনি চাইলে নিজেই কাছাকাছি তারিখ ও অফিস বেছে নিতে পারেন।
পরীক্ষার ধরন সাধারণত নিচের মতো হয়:
- লিখিত/মৌখিক টেস্ট: ট্রাফিক চিহ্ন, রোড রুলস
- ব্যবহারিক টেস্ট: গাড়ি চালানোর দক্ষতা যাচাই
পাস করলে আপনাকে লার্নার লাইসেন্স দেয়া হবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হবে।
প্রাথমিক ড্রাইভিং লাইসেন্স (Learner’s / প্রোগ্রেসিভ লাইসেন্স)
লার্নার লাইসেন্স হল সেই লাইসেন্স যা আপনি প্রাথমিক পর্যায়ে গাড়ি চালানোর জন্য পেয়ে থাকেন।
এই লাইসেন্সের মাধ্যমে আপনি বাস্তবে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।
এটি সাধারণত ৩-৬ মাস মেয়াদী হয়, যা আপনাকে ট্রেনিং এবং পরীক্ষায় প্রস্তুতির সময় দেয়।
আরো জানুন-
NID সংশোধন গাইড ২০২৫- অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবেই
ড্রাইভিং টেস্ট ও মূল্যায়ন পদ্ধতি
বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে ড্রাইভিং টেস্ট পাস করা বাধ্যতামূলক। এই টেস্টের মাধ্যমে একজন প্রার্থী গাড়ি চালানোর যোগ্যতা, নিয়ম-কানুনের জ্ঞান ও নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের দক্ষতা অর্জন করেছে কি না, তা যাচাই করা হয়।
পরীক্ষাটি মূলত দুইটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়: মৌখিক পরীক্ষা ও ব্যবহারিক (প্র্যাকটিক্যাল) পরীক্ষা।
মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা কীভাবে হয়?
মৌখিক পরীক্ষাতে সাধারণত ট্রাফিক সাইন, রোড মার্কিং, ড্রাইভিংয়ের মৌলিক নিয়ম, জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। প্রার্থীকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে তার জ্ঞান প্রকাশ করতে হয়।
ব্যবহারিক পরীক্ষাতে প্রার্থীকে একটি নির্দিষ্ট ট্র্যাকের ভেতরে গাড়ি চালাতে দেওয়া হয়। এখানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকে, যেমন:
- S-রোডে চালানো
- গ্যারেজিং (গাড়ি পার্ক করা)
- ব্রেক ও স্টিয়ারিং কন্ট্রোল
- গিয়ার পরিবর্তন এবং ব্যাকগিয়ার ব্যবহার
- হর্ন ও লাইটের সঠিক ব্যবহার
চূড়ান্ত লাইসেন্স এবং ডেলিভারি
ড্রাইভিং টেস্ট সফলভাবে পাস করার পরই শুরু হয় চূড়ান্ত স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে বিআরটিএ কর্তৃক ইস্যু করা স্মার্ট কার্ড লাইসেন্সটি আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
কবে পাবেন আপনার স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স?
সাধারণত, প্রাথমিকভাবে একটি প্রোভিশনাল রিসিট প্রদান করা হয়, যা লাইসেন্স ডেলিভারির পূর্ব পর্যন্ত সাময়িকভাবে বৈধ।
বিআরটিএ অফিস থেকে স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স পেতে ৭ থেকে ৩০ কার্যদিবস সময় লাগে।
তবে এই সময়সীমা কিছু ক্ষেত্রে বিআরটিএ অফিসের কার্যক্রম বা টেকনিক্যাল কারণে ভিন্ন হতে পারে।
আপনার লাইসেন্স প্রস্তুত হয়েছে কিনা, তা https://bsp.brta.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে রিসিট নম্বর দিয়ে চেক করা যায়।
কোথায় থেকে সংগ্রহ করবেন লাইসেন্স?
স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে নিজ নিজ নির্ধারিত বিআরটিএ অফিস থেকে, যেখানে আপনি আবেদন করেছিলেন।
লাইসেন্স গ্রহণের সময় নিচের কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে হতে পারে:
- প্রোভিশনাল রিসিট
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)
- টেস্ট পাসের প্রমাণপত্র (যদি প্রয়োজন হয়)
কোনো প্রতিনিধি মারফত লাইসেন্স সংগ্রহ করতে চাইলে বিআরটিএ অফিসের নিয়ম অনুযায়ী অনুমতি লাগবে।
লাইসেন্স ফি ও খরচ (2025 আপডেট)
ড্রাইভিং লাইসেন্স করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাটাগরির জন্য ভিন্ন ভিন্ন ফি নির্ধারিত আছে। ২০২৫ সালের আপডেট অনুযায়ী নিচের তালিকায় আলাদা করে উল্লেখ করা হলো।
লাইসেন্স ক্যাটাগরি | মোট ফি (আনুমানিক) |
---|---|
মোটরসাইকেল | ২,৫০০ – ৩,০০০ টাকা |
প্রাইভেট কার | ৩,৫০০ – ৪,০০০ টাকা |
হেভি গাড়ি | ৫,০০০ – ৬,০০০ টাকা |
ট্রেনিং সেন্টার খরচ (যদি থাকে):
অনেক প্রার্থী বেসরকারি ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নেন। এসব সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য অতিরিক্ত ৫,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
এই খরচ ট্রেনিংয়ের দৈর্ঘ্য, কোর্সের মান এবং প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হয়।
লাইসেন্স সংক্রান্ত সাধারণ সমস্যার সমাধান
অনেক সময় অনলাইন ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ সমস্যার সমাধান ও করণীয় তুলে ধরা হলো।
অনলাইন আবেদন করতে সমস্যা হলে করণীয়
অনলাইন সিস্টেমে আবেদন করতে গিয়ে অনেকেই লগইন করতে না পারা, OTP না আসা বা ফর্ম সাবমিট না হওয়ার মতো সমস্যায় পড়েন।
এই অবস্থায় করণীয়:
- অন্য একটি ব্রাউজার বা মোবাইল ব্যবহার করে চেষ্টা করুন
- নিশ্চিত করুন আপনার ইন্টারনেট সংযোগ স্থির
- bsp.brta.gov.bd ওয়েবসাইটের ‘Contact Us’ সেকশন থেকে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারেন
- জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ অফিসে সরাসরি যোগাযোগ করা যেতে পারে
আবেদন স্ট্যাটাস চেক করবেন কীভাবে?
আপনার আবেদনটির অগ্রগতি দেখতে পারবেন অনলাইনেই।
এটি করতে হলে:
- যান bsp.brta.gov.bd
- মেনু থেকে “Application Status” বা “ড্রাইভিং লাইসেন্স স্ট্যাটাস” অপশন বেছে নিন
- আপনার রিসিট নম্বর বা এনআইডি নম্বর দিয়ে সার্চ দিন
ভুল তথ্য সংশোধন ও রি-ইস্যু প্রসেস
আবেদনে ভুল নাম, জন্মতারিখ, এনআইডি নম্বর বা ঠিকানা দিলে তা সংশোধনের জন্য বিআরটিএ-তে আবেদন করতে হয়।
করণীয় ধাপ:
- সংশ্লিষ্ট তথ্যের প্রমাণপত্রসহ সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ অফিসে যান
- সংশোধনের জন্য নির্ধারিত ফি পরিশোধ করুন
- ফর্ম পূরণ করে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র জমা দিন
রি-ইস্যু ক্ষেত্রে স্মার্ট কার্ড হারালে জিডি কপি, আবেদন ফর্ম এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
3 thoughts on “অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স করার পদ্ধতি (A-Z)”